ক্রমশই ভয়াবহ হয়ে উঠছে উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠের পরিস্থিতি
দেবভূমিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে
উত্তরাখণ্ড: স্থানীয় সূত্রে খবর, গত বৃহস্পতিবার যোশীমঠ এলাকা জুড়ে একের পর এক বাড়িতে বিশাল আকারের ফাটল দেখা দিয়েছে। আতঙ্কে ভুগছেন এলাকাবাসী। উত্তরাখণ্ড প্রশাসনও যথেষ্ট চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। তারা যথাসাধ্য পরিকল্পনা নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজে নেমে পড়েছে। যোশীমঠে ভূমিধসের মাত্র কয়েক মাস আগেই বেশ কয়েকটি ছোটোখাটো ফাটল লক্ষ্য করেছিলেন বাসিন্দারা। তা উপেক্ষা করাতেই কী বড়সড় বিপর্যয় উঠছে নানা মহলে প্রশ্ন।
গত শনিবার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যোশীমঠ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুস্কর সিং ধামি। তার পরে দেরাদুনে তিনি আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠকও করেন। রবিবার তাঁকে টেলিফোন করে যোশীমঠের পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন প্রধনমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এদিন বিকেলে যোশীমঠ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব সহ উচ্চ পদস্থ আধিকারিকেরা। ছিল জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরও। যোশীমঠের স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরাও ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে উপস্থিত ছিলেন এদিনের বৈঠকে। অন্যদিকে, এদিনই যোশীমঠে যান উত্তরাখণ্ডের প্রধান সচিব।
পুরসভার হিসাব অনুয়ায়ী প্রায় ৬০০টিরও বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে ১৫৩টি বাড়ি রবিগ্রামে, ১২৭টি বাড়ি গান্ধীনগরে, ৭১টি বাড়ি মনোহরবাগে, ৫২টি বাড়ি সিংধরে, ৫০টি বাড়ি পারসারে, ২৯টি বাড়ি আপা বাজারে, ২৭টি বাড়ি সুনীলে, ২৮টি বাড়ি মারওয়াড়িতে, ২৪টি বাড়ি লোয়ার বাজারে। আউলি রোপওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চারধাম অলওয়েদার রোড প্রকল্পও সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। যে কোনও সময় তাদের বাড়ি ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। শহরের রবিগ্রাম, গান্ধিনগর ও সুনীল ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা গিয়েছে। ইতিমধ্যেই ফাটল দেখা দিয়েছে শংকরাচার্য মঠের দেওয়ালেও। শঙ্করাচার্য মঠের লোকজনের মতে, গত ১৫ দিনে এই ফাটল বেড়েছে। শঙ্করাচার্য মঠের প্রধান স্বামী বিশ্বপ্রিয়ানন্দ এই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে ‘উন্নয়ন’কেই চিহ্নিত করেছেন।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রের খবর, যোশীমঠের সাম্প্রতিকতম বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথও। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলা যোশীমঠ-মালারি বর্ডার রোড এই এলাকার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে চিনা বর্ডারের। সীমান্তগামী সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথের একাধিক জায়গায় দেখা দিয়েছে ধস। ফলে এই সড়কপথের বহু জায়গাতেই বড়ো বড়ো ফাটল তৈরি হয়েছে। সেটাও চিন্তায় রেখেছে প্রশাসনকে।
গত রবিবার উত্তরাখণ্ডের মন্দিরনগরী যোশীমঠকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভূমিধস প্রবণ অঞ্চল বলে ঘোষণা করেছে প্রশাসন। প্রধানমন্ত্রী দফতরে বৈঠক শেষে একগুচ্ছ আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। জানানো হয়, যোশীমঠের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আপাতত তিনি সাধারণ মানুষের সাহায্যে দ্রুত যে পদক্ষেপগুলি করা যায়, তার উপরে জোড় দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কেন্দ্র ইতিমধ্যেই যোশীমঠে একটি NDRF দল ও ৪টি SDRF দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যে বাড়িগুলিতে ফাটল দেখা দিয়েছে, সেই সমস্ত বাড়ির বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের প্রধান সচিব প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে জানিয়েছেন, আগামিকাল যোশীমঠ পরিদর্শন করবে সেক্রেটারি বর্ডার ম্যানেজমেন্ট এবং জাতীয় বিপর্যয় ম্যানেজমেন্ট অথরিটির প্রতিনিধি সদস্যেরা। এছাড়া, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, আইআইটি রুরকি, ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অফ হিমালয়ান জিওলজি-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞেরা যোশীমঠ এলাকার মাটি, মাটির স্তর, ভূ-প্রকৃতি ইত্যাদি পর্যালোচনা করে তাঁদের মতামত জানাবেন।
যোশীমঠের সংকটের কারণ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোশীমঠ ডুবতে শুরু হওয়ার অন্যতম বড়ো কারণ এই শহরের ভৌগোলিক অবস্থান এবং গঠন। হিমালয়ের ভূমিধসের উপরেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে উঠছিল উত্তরাখণ্ডের এই জনপদ। যোশীমঠের মাটির ভারবহন ক্ষমতা সেই কারণেই কম। প্রকৃতির ক্ষমতার তোয়াক্কা না করেই ছোট্ট জনপদ যোশীমঠ হয়ে উঠেছে শহর। পাহাড়ের গায়ে বাড়ি, হোটেল তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, গত কয়েক বছরে বেপরোয়া নির্মাণ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, এবং জাতীয় সড়ক প্রশস্ত করার কাজে আরও চাপ বেড়েছে প্রকৃতির উপর। উন্নয়নের নেশায় মত্ত মানুষ খেয়ালই করেনি কখন প্রকৃতির সহ্যের বাঁধ ভেঙেছে, তাই প্রকৃতি আজ ধ্বংসের মুখে।