এই শীতে নবদ্বীপ ধাম এবং মায়াপুরের ইস্কন মন্দির ভ্রমণ করুন
ধর্মীয় স্থান ভ্রমণের স্বাদই আলাদা
শীতকালে আমরা সকলেই পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে যেতে ভালোবাসি। কিন্তু পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের নিয়ে যদি ২ দিনের ছুটিতে কোনও ধর্মীয় স্থান ঘুরে আসা যায় তবে ব্যাপারটা পুরো জমে যাবে। আমরা নবদ্বীপ ধাম এবং মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরের কথা শুনেছি। আপনি যদি একবারও এখানে না গিয়ে থাকেন তবে পরিবারের সকলকে নিয়ে রেলপথে বা সড়কপথে বেড়িয়ে পড়ুন নদীয়ার উদ্যেশে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে ঐতিহাসিক অঞ্চল হিসেবে নদিয়া জেলার আত্মপ্রকাশ হয় ১৭৮৭ সালে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী নামক একজন জনৈক ব্যক্তির মতানুসারে, ভাগীরথীর তীরে চরভূমিতে একজন তান্ত্রিক ন’টি প্রদীপ জ্বালিয়ে তন্ত্র সাধনা করতেন। দূর থেকে এই জায়গাটিকে দেখে লোকে ন’দিয়ার চর বলতেন, সেই থেকেই লোকমুখে প্রচলিত হয় এই ‘নদিয়া’ নামটি। নদীয়া জেলায় ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত নবদ্বীপ। ভাগীরথী ও জলঙ্গীর সংযোগস্থলে অবস্থিত মায়াপুর। মূলত শ্রী চৈতন্য দেব ও ইস্কন চন্দ্রোদয় মন্দিরের জন্য বিখ্যাত এই দুই স্থান। শ্রী চৈতন্য দেবের ভক্তদের কাছে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। তবে সকল ধর্মের মানুষের অবাধ প্রবেশ আছে এই ইস্কন চন্দ্রোদয় মন্দিরে।
নবদ্বীপ:
বাংলায় সেন রাজাদের আমলে নবদ্বীপ ছিল বাংলার রাজধানী। লক্ষণ সেন গৌড় থেকে তার রাজধানী সরিয়ে আনেন নবদ্বীপে। ১২০৬ সালে লক্ষণ সেনের আমলে বখতিয়ার খিলজি নবদ্বীপ জয় করেন ও তখন থেকেই বাংলায় প্রথম মুসলিম শাসন শুরু হয়। তখন নবদ্বীপ ছিল বাংলার শিক্ষালাভের প্রধান পীঠস্থান। শ্রী চৈতন্য দেব এই নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীচৈতন্য দেবের জন্ম ভিটা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও নবদ্বীপে বর্তমানে ১৮৬ টি মন্দির আছে ও সব গুলিতেই ভজন ও কৃষ্ণনাম হয়।
নবদ্বীপ জুড়ে একের পর এক মন্দির আর মঠের সারি। রিকশা ভাড়া করে বা পায়ে পায়ে ঘুরে নেওয়া যায় মন্দিরগুলি। মহাপ্রভুর বিগ্রহ মন্দির, বুড়ো শিব, হরিসভা, পোড়ামাতলা মহাপ্রভু মন্দির, অদ্বৈতপ্রভু মন্দির, জগাই-মাধাই, শচীমাতা-বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটায় নিত্যানন্দপ্রভুর মন্দির, বড় আখাড়া, শ্রীশ্রী গোবিন্দজিউ, সোনার গৌরাঙ্গ, সমাজবাড়ি, বড় রাধেশ্যাম, রাধাবাজারে শ্রীসারস্বত গৌড়ীয় আসন, দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ, মণিপুর পাড়ায় সোনার গৌরাঙ্গ, ইত্যাদি। নবদ্বীপের সবচেয়ে বড়ো অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম হল রাস-উৎসব। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে খুব ধুমধাম করে রাস উৎসব পালন করা হয়। এছাড়াও দোল পূর্ণিমা, চন্দন যাত্রা, ধুলোট মেলা, গঙ্গা পুজো, ঝুলন যাত্রা প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি খুব বড়ো করে এখানে পালিত হয়।
মায়াপুর:
মায়াপুর হল নদিয়া জেলার একটি বিশেষ গ্রাম এবং পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। ভাগীরথী নদীর পূর্বপাশে এই মায়াপুর অবস্থিত। মায়াপুরের খুব কাছে জলঙ্গী নদী ভাগীরথী নদীতে মিশেছে। মায়াপুরের ইস্কন মন্দির সবথেকে বড়ো বৈদিক মন্দির। মন্দিরের চূড়ায় সোনার পাতে মোড়া এবং স্টেনলেস স্টিলে তৈরি করা একটি সুদর্শন চক্র অবস্থিত। যার উচ্চতা ২৩ ফুট এবং ওজন প্রায় দেড় টন। এই চক্রটি তৈরি হয়েছে রাশিয়াতে। খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এছাড়াও ইস্কন মন্দিরে রয়েছে প্রভুপাদ-এর সমাধি। শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হিসাবে মায়াপুরে ‘চন্দ্রোদয় মন্দির’ নির্মাণ করেন সন্ত বিনোদ ঠাকুর। চন্দ্রোদয় মন্দিরে গোপিনী পরিবেষ্টিত শ্যাম-রাইয়ের মূর্তি রয়েছে। এছাড়াও এখানে ছেলেদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য রয়েছে বৈদিক একাডেমি। পর্যটকদের জন্য এখানে ভোগ প্রসাদের ব্যবস্থা রয়েছে এবং কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে এখানে বিভিন্ন ভবনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় পর্যটকদের থাকার জন্য। যে ইস্কন মন্দিরের দৌলতে মায়াপুরের আজ জগৎজোড়া নাম সেই মন্দির দিয়ে শুরু করতে পারেন গৌরতীর্থ মায়াপুর দর্শন।
ইস্কন মন্দির থেকে বেরিয়ে শ্রীচৈতন্য দেবের গৌড়ীয় মঠ। এর পর অদ্বৈত ভবন, ২৯ চুড়োর শ্রীচৈতন্য মঠ এবং শ্রীবাস অঙ্গন তথা খোল ভাঙার ডাঙা। রয়েছে ভক্তি সারঙ্গ গোস্বামী মহারাজ মঠ, জন্মভিটে তথা শ্রীমন্দির। ২৯ চুড়োর মঠের উল্টো দিকে পুণ্যিপুকুর শ্যামকুণ্ড, একই চত্বরে রাধাকুণ্ড ইত্যাদি।
এছাড়াও মায়াপুরের রয়েছে আরও অসংখ্য মন্দির। তবে বেশিরভাগ মন্দিরগুলো দুপুর ১টা থেকে ৩টে অবধি বন্ধ থাকে এবং এই সমস্ত মঠের নিয়ম অনুযায়ী মন্দির প্রাঙ্গণে মোবাইল ফোন আর ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলা বা প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। এছাড়া একসঙ্গে আপনারা শান্তিপুরের ভ্রমণ করতে পারেন, শান্তিপুরে ও বেশকিছু মন্দির এবং তীর্থস্থান আছে। এখানের স্থানীয় অনুষ্ঠানগুলি হল জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, স্নানযাত্রা, শ্রীল প্রভুপাদ-এর ব্যাস পুজো, দোলযাত্রা প্রভৃতি।
কোথায় থাকবেন-
নবদ্বীপ ধাম এবং মায়াপুরে ট্যুরিস্ট লজ, বেসরকারি লজ, ধর্মশালা ও অথিতিশালায় পর্যটকদের থাকার সুবন্দোবস্ত আছে।
কীভাবে যাবেন-
হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল অথবা শিয়ালদহ থেকে ভাগীরথী এক্সপ্রেস ধরে আসা যাবে এই দুই ধর্মীয় স্থানে।আবার কলকাতা থেকে অনেক বাস আছে সরাসরি মায়াপুরের। ইস্কনের বাস ও আছে সরাসরি কলকাতা থেকে। নবদ্বীপে যাবার জন্য মায়াপুর থেকে খেয়া পার করতে পারেন। নিজেদের গাড়িতে এলে কলকাতা থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩৪ ধরে রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর পার করে পৌঁছে যাবেন মায়াপুরে।