এই শীতে ঘুরে আসতে পারেন টেরাকোটার দেশ বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর দিয়ে
বিষ্ণুপুরকে মন্দিরনগরীও বলা হয়
টেরাকোটার দেশ বিষ্ণুপুর: বিষ্ণুপুর একটি মন্দিরপ্রধান হেরিটেজ ডেস্টিনেশন, তাই এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দর্শনীয় স্থানই ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরবিশেষ। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর নামক মন্দির শহরটি আপনাকে তার দুর্দান্ত ঐতিহ্য, গর্বিত সংস্কৃতি, উজ্জ্বল স্থাপত্য এবং পোড়ামাটির গল্পগুলি দ্বারা স্বাগত জানায়। আদি মল্ল, মল্ল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দশম মল্ল রাজা জগত মল্ল তাঁর রাজ্য বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করেছিলেন। বাংলায় পাথরের স্বল্প সরবরাহের কারণে পোড়া মাটির ইটগুলি বিকল্প হিসাবে এসেছিল এবং এইগুলি ‘টেরাকোটা’ নামে পরিচিত। একটি সুন্দর কারুকাজের নতুন পথ খুঁজে পেয়েছিলেন মল্ল রাজারা। সপ্তদশ শতাব্দীতে, পোড়ামাটির শিল্পটি সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। রাজা জগৎ মল্ল এবং তাঁর বংশধররা পোড়ামাটির ও পাথরের শিল্প দ্বারা নির্মিত অসংখ্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
টেরাকোটা শৈলীর ওপর ভিত্তি করে বিষ্ণুপুরের নিজস্ব হাতি এবং ঘোড়ার মূর্তি খুবই বিখ্যাত। একসময়ে এগুলি ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকলেও বর্তমানে তা শিল্পকর্মের নিদর্শন হিসেবেও সুখ্যাতি লাভ করেছে। পাঁচমুড়া, রাজগ্রাম, সোনামুখী বা হামিরপুর অঞ্চলের মৃৎশিল্পকলা বিখ্যাত। সোনামুখী এবং পাঁচমুড়ার মনসচালি, মা মনসার পূজাকর্মে ব্যবহৃত বিশেষ মাটির শিল্পকর্মও খুবই বিখ্যাত। এছাড়াও কাঠের, বাঁশের, তামার, পাথরের এবং পিতলের ওপরেও নানা কাজ করা হয়। স্থানীয় শিল্পীদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে জিনিসগুলো সংগ্রহ করা যেতে পারে।
বিষ্ণুপুরের তাঁত শিল্পীদের জ্ঞান এবং দক্ষতার প্রকাশ পাওয়া যায় এখানকার বালুচরী শাড়িতে, যা গোটা ভারতবর্ষে বিখ্যাত। বিভিন্ন স্থানীয় মন্দিরের দেওয়ালের পৌরাণিক নানা দৃশ্য এখানকার তাঁতিরা তাদের শাড়িতে ফুটিয়ে তোলেন। বালুচরী বাদে এখানকার স্বর্ণচরী এবং তসর সিল্কের শাড়িও খুব জনপ্রিয়।
এইসব সুন্দর সুন্দর নিদর্শনগুলির জন্য বিশ্ববিখ্যাত এই হেরিটেজ ডেস্টিনেশনে বেড়াতে আসার পরিকল্পনা করতে পারেন এই শীতে। এমন একটি শহর ঘুরে দেখুন যা টেরাকোটার ভাষা বলে। পোড়ামাটির শিল্পকর্মের দর্শনীয় পদচিহ্নগুলি সহ অসংখ্য কাঠামোর মধ্যে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীগুলি সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
বিষ্ণুপুরের ঐতিহাসিক তাৎপর্য:
ঐতিহাসিক রাঢ় বঙ্গের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বিষ্ণুপুর। বিষ্ণুপুরের উত্থান শুরু হয় সপ্তদশ শতকে, যখন রাজা আদি মল্ল রাঢ় অঞ্চলের রাজা হিসেবে মল্ল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রায় ৩০০ বছর পরে দশম মল্ল রাজা জগৎ মল্ল বিষ্ণুপুরে নিজেদের সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তী প্রায় ৮০০ বছর ধরে মল্লরাজেদের শাসনে বিষ্ণুপুরের নানাবিধ উন্নতি হয় এবং এই সময় থেকেই সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হিসেবে বিষ্ণুপুরের এগিয়ে চলা শুরু। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে বিষ্ণুপুরে নানা প্রাচীন মন্দির স্থাপন করা হয়, কিন্তু সেগুলির কোনও অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে স্থাপিত টেরাকোটা নির্মাণশৈলীর মন্দিরগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং আজও আমরা এই মন্দিরগুলোকে দেখতেই সেখানে যাই। শুধু টেরাকোটা নয়, ল্যাটেরাইট পাথরের তৈরি বেশ কিছু মন্দিরও আছে। বাংলার মন্দিরশিল্পের বিভিন্ন নিদর্শন, যেমন চালা বা রত্নার প্রচলন এখানের বিভিন্ন মন্দিরে দেখা যায়।
ঐতিহ্যশালী বিষ্ণুপুর ঘুরতে যাওয়ার বিস্তৃত বিবরণী সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
রাসমঞ্চ:
এটি বিষ্ণুপুরের সবথেকে পুরনো স্থাপত্যের নিদর্শন। রাসমঞ্চ, ইটের তৈরি এই প্রাচীনতম মন্দিরটি রাজা হাম্বির ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাসমঞ্চের স্থাপত্যশৈলী অন্য সকল মন্দিরের থেকে আলাদা। আড়ম্বরপূর্ণ মন্দিরটি স্থাপত্যগতভাবে এতই অনন্য এবং অতুলনীয় যে এটি পুরো বাংলার পাশাপাশি সারা দেশে অনন্য। রাসের সময়, বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন মন্দিরের মূর্তি এই মঞ্চে নিয়ে আসা হয় এবং দর্শকরা ঘুরে দেখতে পারেন।
রাধাশ্যাম মন্দির:
একরত্ন এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছে ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে, অঙ্গসজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে চুনাপাথর। মন্দিরের চার ধারে উঁচু প্রাচীর দেখা যায়।
শ্যামরাই মন্দির:
শ্যামরাই মন্দিরটি ১৬৪৩ সালে রাজা রঘুনাথ সিংহ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এটি পাঁচটি চূড়ার মালিক হিসাবে পঞ্চরত্ন মন্দির নামে পরিচিত এই মন্দিরটি। বিষ্ণুপুরের সবথেকে বড়োমন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম। এই মন্দিরের মাথায় পাঁচটি চূড়া বা রত্ন দেখা যায়। মন্দিরটির চারপাশে তিন তোরণযুক্ত পথ সহ সুন্দর দেখায়। এটি অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় প্যানেলে দর্শনীয় পোড়ামাটির শিল্প-রূপগুলির কারণে এটি বিষ্ণুপুরের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। মন্দিরগাত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা গাথা টেরাকোটা শৈলীতে খোদাই করা আছে।
জোড়বাংলা মন্দির:
জোড়বাংলা মন্দিরটি মল্ল রাজা রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের পোড়ামাটির শিল্পের অন্যতম ব্যতিক্রমী উদাহরণ এবং একটি অনন্য স্থাপত্য কাঠামোর মালিক। মন্দিরটির বিশেষ “দো-চালা” আকারের কারণে “জোড়বাংলা” নামকরণ করা হয়েছে। মন্দিরটির ছাদটি পাশাপাশি দ্বি-পার্শ্বযুক্ত বাঁকান অংশ, যথাক্রমে বারান্দা এবং মন্দির বলা হয়, এগুলি পরস্পর যুক্ত। মহাভারত, রামায়ণ, কৃষ্ণের বাল্যকালের একাধিক দৃশ্য চিত্রিত আছে মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির ভাস্কর্য দ্বারা।
মদনমোহন মন্দির:
মল্ল রাজা দুর্জন সিংহ দেব ১৬৯৪ সালে ভগবান মদন মোহন-এর নামে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপনি যখন বিষ্ণুপুর ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন তবে এই ‘বিষ্ণু’ মন্দিরটি অবশ্যই দেখবেন। মন্দিরটি তার দেহের মধ্যে সেরা পোড়ামাটির শিল্পের বার্তা বহনকারী অন্যতম প্রধান কাঠামোগত রূপ। এটি আজ অবধি একটি সক্রিয় মন্দির।
তাছাড়া রাসমঞ্চের দক্ষিণে একটু এগিয়ে এলে দেখতে পাবেন বেশ কয়েকটি একরত্ন মন্দির, যাদের মধ্যে ছিন্নমস্তার মন্দিরটি জাগ্রত হিসাবে খ্যাত। এছাড়া কাছেই আছে নন্দলাল মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, রাধামাধব মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির ইত্যাদি। রাসমঞ্চের আসে পাশে আছে বিখ্যাত মৃন্ময়ী মন্দির। দেখতে পারেন গুমঘর এবং বড়ো ও ছোট পাথর দরজা। গুমঘর একটি ছোট টিলার ওপর অবস্থিত সুবিশাল বর্গাকার জানলাবিহীন এক কাঠামো, মনে করা হয়ে আগে এটি কারাদণ্ডাগার হিসেবে ব্যবহৃত হত। একসময় বিষ্ণুপুরের চারদিকে উঁচু প্রাচীর ছিল, শহরটিকে শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্যে। সেই দেওয়ালের সেরকম কিছু অবশিষ্ট নেই, ল্যাটেরাইট পাথরের তৈরি একটি বড় এবং একটি ছোট দরজা এখনও আছে, সেখানে তৎকালীন সৈন্যবাহিনী পাহারা দিত এবং শুধুমাত্র এই দরজাগুলো ব্যবহার করেই অধিবাসীরা বিষ্ণুপুরে যাওয়া আসা করতে পারতেন। মন্দিরগুলোর থেকে অল্প দূরে আছে ১৭৪২ সালে তৈরি বিশালাকার দলমাদল কামান। কথিত আছে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের সময় রাজা মদনমোহন স্বহস্তে এই কামানের সাহায্যে মারাঠা বাহিনিকে পরাস্ত করেছিলেন।
কোন সময় যাবেন-
গরমকালে বিষ্ণুপুর না যাওয়াই ভালো, তাপমাত্রা খুবই বেশি থাকে। তবে বছরের অন্যান্য সময়ে, বিশেষত রাসের সময়, পুজোর সময় বা শীতকালে বিষ্ণুপুর উৎসবের সময় যেতে পারেন। শীতেকালে এখানে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে।
কীভাবে যাবেন-
হাওড়া থেকে আপনি বাঁকুড়াগামী অনেক ট্রেন পেয়ে যাবেন বিষ্ণুপুর আসার জন্য। বাঁকুড়া থেকেও আপনি বিষ্ণুপুরে ট্যাক্সি, বাস বা ট্রেন নিতে পারবেন। সড়কপথে আসতে চাইলে ধর্মতলা ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাস আছে বিষ্ণুপুর আসার জন্য। অথবা নিজেদের গাড়ি থাকলে কলকাতা থেকে ডানকুনি হয়ে দুর্গাপুর ও আরামবাগ হয়ে পৌঁছনো যায় এখানে।