রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের বাজেট বক্তৃতায় উঠে এসেছে কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা
বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগেই ‘সিলমোহর’ দিলেন রাজ্যপাল
অতীতকাল থেকেই বাংলার মানুষ দেখেছে রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাত। প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সাথে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে রাজ্যের সংঘাত। তিনি উপরাষ্ট্রপতির আসনে জয়লাভ করার পর বাংলার নতুন রাজ্যপাল হয়ে আসেন ড. সি ভি আনন্দ বোস। বাংলার রাজ্যপাল হয়ে আসার পরে রাজ্যের বাজেট অধিবেশনে বিধানসভায় সি ভি আনন্দ বোসের গতকাল অর্থাৎ বুধবারই ছিল প্রথম ভাষণ। সাধারণত বিধানসভায় নতুন বছরে প্রথম অধিবেশন শুরু হয় বাজেট অধিবেশনের মাধ্যমে। প্রথাগত ভাবে বিধানসভার সেই অধিবেশনের শুরু হয় রাজ্যপালের ভাষণ দিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরেই সরব রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। আর দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রাজ্যের প্রাপ্যে নিয়ন্ত্রণ চেয়ে পথে নেমেছে বিরোধী দল বিজেপি।
এবার সেই রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগেই ‘সিলমোহর’ দিলেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। বুধবার বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের প্রারম্ভিক ভাষণে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের গলায় শোনা গেল কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যকে বঞ্চিত করার অভিযোগ। যদিও, প্রথাগত ভাবে রাজ্য সরকারের লিখিত ভাষণই রাজ্যপাল পাঠ করেছেন বলে জানা গিয়েছে। তবে এ নিয়ে রাজ্যপালের তরফে আপত্তি জানানোর সুযোগও থাকে। অনেক সময় সরকারের তৈরি বক্তৃতার সঙ্গে সহমত না হলে রাজ্যপাল প্রথম এবং শেষাংশ পড়ে নিয়মরক্ষা করে থাকেন। কিন্তু এ বার তা হয়নি। যে প্রশ্নে রাজ্যের শাসক ও বিরোধীদের লাগাতার যুদ্ধ চলছে সেই উন্নয়নের প্রশ্নে রাজ্যপাল সরকারের তৈরি বক্তৃতা সম্পূর্ণ পাঠ করে তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন বলেই রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত। রাজ্য রাজনীতিতে কেন্দ্র-রাজ্য দড়ি টানাটানির মধ্যে রাজ্যপালের ভাষণে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার লিখিত অভিযোগ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
বক্তৃতায় রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস তাঁর লিখিত ভাষণে বলেছেন, ”আমার সরকার রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে সমস্ত অত্যন্ত জনপ্রিয় ও জনমুখী নীতি অবলম্বন করেছে তার ফলে এই রাজ্য সাধারণ মানুষের প্রাথমিক চাহিদাগুলি মেটানোর নিরিখে দেশের মধ্যে অগ্রণী রাজ্যগুলির অন্যতম হয়ে উঠেছে। তবে, যে তিনটি ক্ষেত্রে এ বছর আমরা বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারিনি সেগুলি হল – এম জি এন আর ইজিএ(১০০ দিনের কাজ), গ্রামীণ আবাসন ও গ্রামীণ সড়ক। ২০২১ – ২২ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ এই ক্ষেত্রগুলিতে প্রথম স্থানে ছিল। কিন্তু, এ বছর রাজ্য এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রের কাছ থেকে তার প্রাপ্য টাকা পায়নি। ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকারও বেশি পাওনা বকেয়া হয়ে রয়েছে।”
শুধু আবাস-সহ তিনটি যৌথ প্রকল্পে বঞ্চনার অভিযোগই নয়। রাজ্যপালের পাঠ করা বাজেট বক্তৃতায় আরও যে বিষয় রাজনৈতিক মহলের নজর কেড়েছে, তা হল শিক্ষা। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক স্তরে যে আলোড়ন চলছে এ দিন সেই ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের ১০ বছরের অগ্রগতিরই হিসেব রয়েছে রাজ্যপালের বক্তৃতায়। রাজ্যপালের কথায়, ‘‘বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৭২৫১টি নতুন বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ২৮৮৬টি নতুন বিদ্যালয় খোলা হয়েছে।’’ স্মার্ট ফোন কিনতে সরকারের দেওয়া ১০ হাজার টাকা, সংখ্যালঘু বৃত্তি হিসেবে ৬৬৮৪ কোটি টাকা দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই বক্তৃতায়। উচ্চশিক্ষার উন্নতিতে সরকারি পদক্ষেপের বিবরণ দিয়েছেন রাজ্যপাল। যে নিয়োগ দুর্নীতি এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বিরোধীরা রাজ্য সরকারকে প্রতিনিয়ত কাঠগড়ায় তোলে, রাজ্যপালের বক্তৃতায় তা খারিজ করে দুই ক্ষেত্রেই সরকারি সফাল্যের দাবি করা হয়েছে।
আবার যে ‘মিড-ডে মিল’ নিয়ে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অতিসম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল, তা নিয়েও সন্তোষ স্পষ্ট হয়েছে রাজ্যপালের বক্তৃতায়। এ সম্পর্কে বক্তৃতায় রাজ্যপাল বলেছেন, ‘‘১ কোটি ১৮ লক্ষের বেশি পড়ুয়াকে মিড-ডে মিল প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে এবং মিড-ডে মিল রান্নার জন্য ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে এলপিজি সংযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে।’’ এ ছাড়াও ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর মতো সহায়তা প্রকল্প, শিল্প- কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ, পরিবহণ দফতরের কাজকর্ম সাফল্য হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে রাজ্যপালের বক্তৃতায়।
রাজ্যপালের বক্তৃতায় সরকার মিথ্যা তথ্য দিয়েছে বলে দাবি করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর কথায়, ‘‘বঞ্চনার অভিযোগ কোথা থেকে এল? রাজ্যপাল যতই সরকারের লিখে দেওয়া মিষ্টি কথা বলুন না কেন, আমরা তাঁকে প্রকৃত তথ্য দেব।’’ এই সূত্রে তিনি ফের বলেন, ‘‘কেন্দ্র আবাস যোজনা বা ১০০ দিনের কাজের মতো নানা প্রকল্পেই টাকা দিয়েছে। রাজ্য সরকার কেন্দ্রের টাকা নয়ছয় করেছে।’’
রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের এই ভাষণের পর রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আজকের দিনের ছবির সঙ্গে বিগত বছর বাজেট অধিবেশনের ছবিটা মেলাতে চেয়েছেন। পর্যবেক্ষকদের চোখে ভেসে উঠেছে, প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের এই ভাষণ নিয়ে নবান্ন ও রাজভবনের মধ্যে টানাপোড়েন চরমে উঠেছিল। অধিবেশনের আগে রাজ্যের তৈরি ভাষণের কপি ২ দফায় নবান্নের কাছে চেয়ে পাঠিয়েছিলেন প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। রাজ্যের তৈরি সেই ভাষণের বেশ কিছু জায়গায় সংশোধন না করলে তাঁর পক্ষে ভাষণ পাঠ করা সম্ভব হবে না বলেও রাজ্যকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাজ্য পরিবর্তনে রাজি হয়নি। শেষপর্যন্ত বাজেটের মতো বিষয়ে সাংবিধানিক সংকট এড়াতে ভাষণের একটি বাক্য পাঠ করেই ‘নিয়মরক্ষার ভাষণ’ শেষ করেছিলেন তিনি।
কিন্তু এবার ছবিটা একেবারে বিপরীত। বিজেপি সহ সমস্ত বিরোধীরা যখন আগাম আশঙ্কাপ্রকাশ করে দাবি করেছিল, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য – নানা কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগকে ঢাকতে কৌশলে রাজ্যপালের ভাষণে রাজ্যপালকে দিয়ে সরকারের গুনগান করানো হবে, তখন বর্তমান রাজ্যপাল আনন্দ বোস আগেই জানিয়ে ছিলেন তিনি তাঁর সরকারের ‘পূর্ণাঙ্গ ভাষণ’ পাঠ করতে চান। বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনের শুরুর দিনেই বেনজির ঘটনার থাকে সাক্ষী রাজ্য। রাজ্যপালের ভাষণের মাঝখানেই হৈ-হট্টগোল শুরু করে দেন বিজেপি বিধায়কেরা। তাঁর বক্তৃতার মাঝেই ‘জয় শ্রীরাম” স্লোগান তোলে বিজেপি। রাজ্যপালের বক্তৃতার মাঝেই ওয়াকআউট। গোটা ঘটনার তীব্র নিন্দায় সরব তৃণমূলও।