“শান্তির জায়গা হল শান্তিনিকেতন,” হাতে মাত্র ২ দিনের ছুটি থাকলে আসতে পারেন বোলপুর শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতনের সাথে বাঙালি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত
বাঙালিদের কাছে বোলপুর খুব কাছের একটি প্রিয় স্থান। শান্তিনিকেতন যায়নি এমন বাঙালি খুব কমই আছেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য পরিচিত এই স্থানটি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গ্রীষ্মে কৃষ্ণচূড়া দেখতে, বর্ষায় সবুজ রঙে রাঙায়িত হতে, শরতে কাশফুল ছুঁতে, হেমন্তে ঝরা পাতার শব্দ শুনতে, শীতে শীতলতার স্পর্শ পেতে, বসন্তে পলাশ, শিমুল আর অশোকের রূপে প্রমত্ত হতে বাঙালিরা এখানে আসেন।
খোয়াই হাট, কোপাই নদীর পার, বিশ্ববাংলা হাটের চাতাল, সোনাঝুরির লাল ধুলো, সৃজনী গ্রামের বহুমুখী রূপ, রায়পুর জমিদার বাড়ির ইটের পাঁজরের ইতিহাস, লাল বাঁধের লাবণ্য, ডিয়ার পার্কের চঞ্চল হরিণের চোখট, ডোঙালি কালি মন্দিরের সন্ধ্যা, কঙ্কালী তলার পবিত্রতা এইসব কিছু নিয়েই বোলপুর পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
শান্তিনিকেতনের ইতিহাস:
১৮৬২ সালে কিংবদন্তি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি শান্ত স্থান খুঁজে পেয়েছিলেন, যেখানে তিনি শান্তিতে ধ্যান করতে পারেন। সেই স্থানটিকে শান্তির উপদেষ্টা বিবেচনা করে তিনি এর নামকরণ করেন শান্তিনিকেতন। তারপর লোকেরা এটিকে একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে, যেখানে প্রচুর লোক প্রার্থনা এবং ধ্যানের জন্য জড়ো হত এবং তারপরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে একটি আশ্রমের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনেই একটি বিদ্যালয় শুরু করেন। তিনি এটির নাম দেন “পাঠ ভাবনা” যা মাত্র পাঁচজন ছাত্র দিয়ে শুরু হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, তখন বিদ্যালয়টি একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তৃত হয় যার নাম হল বিশ্বভারতী। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ক্যাম্পাস রয়েছে, একটি শান্তিনিকেতনে এবং অন্যটি শ্রীনিকেতনে যা হস্তশিল্পের পাশাপাশি গ্রাম কল্যাণ, বয়স্ক শিক্ষা, কৃষি এবং কুটির শিল্পের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
শান্তিনিকেতনের প্রধান আকর্ষণগুলি কী কী:
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়:
কবিগুরুর তৈরি করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশ-বিদেশ থেকে বহু পড়ুয়ারা পড়তে আসে। বিশ্বভারতী ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য।
পৌষ মেলা:
১৮৪৩ সালের ২১ই ডিসেম্বর (১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কুড়ি জন অনুগামীকে নিয়ে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের থেকে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। এটিই শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসবের মূল ভিত্তি। তারপর ১৮৯১ সালের ২১ই ডিসেম্বর (১২৯৮ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ) শান্তিনিকেতনে একটি ব্রাহ্মমন্দির স্থাপিত হয়। ১৮৯৪ সালে ব্রাহ্মমন্দিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী স্মরণে মন্দিরের উল্টোদিকের মাঠে একটি ছোটো মেলা আয়োজন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের সেই পৌষমেলা শুধুমাত্র বীরভূম জেলার নয়, অন্যান্য অঞ্চলের পর্যটকেদেরও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এই মেলা দেখতে পর্যটকরা ভিড় জমাতে আসেন।
ছাতিমতলা:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ধ্যান এবং আত্মদর্শন হল বিশ্ব উন্নতির পাশাপাশি সাফল্যের চাবিকাঠি। যে ব্যক্তি নিজেকে প্রার্থনায় নিমগ্ন করতে চায় তাকে অবশ্যই এই শান্ত স্থানটি দেখতে হবে যা নির্মল নামী গাছ দ্বারা বেষ্টিত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে বসে ধ্যান করতেন।
সোনাঝুড়ি হাট:
শান্তিনিকেতনের একটি স্থান আছে যার নাম সোনাঝুরি। এই জায়গাটি একটি বিখ্যাত টুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। এই জায়গাটি সপ্তাহের শেষে এক থেকে দু দিন কাটানোর জন্য একটি সুন্দর ট্রাভেল ডেস্টিনেশন। সোনাঝুরির প্রধান আকর্ষণ হল দুই দিনের মেলা বা হাট যাকে সোনাঝুরি হাট বা শনিবারের হাট বলা হয়। এটিকে আবার খোয়াই হাটও বলা যেতে পারে। খোয়াই-শান্তিনিকেতনে সোনাঝুরি গাছের শুকনো জঙ্গলে এর অবস্থান। সোনালি ফুলের এই গাছগুলির বৈশিষ্ট্য একটু অন্যরকম। বীরভূমের লাল ল্যাটেরাইট মাটিতে সহজেই বেড়ে ওঠে। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে শান্ত কোপাই নদী। কোপাই এবং সোনাঝুরি জঙ্গলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বহু রচনায় এগুলির প্রসঙ্গ এসেছে।
এই হাটে হস্তশিল্পের বিচিত্র সম্ভার সত্যিই অবাক করার মতো। এত আকর্ষণীয় হাট থেকে কিছু না কিনে আপনি ফিরতেই পারবেন না। বিক্রেতাদের মধ্যে প্রচুর আদিবাসী কারিগরও আছেন। অনবদ্য তাঁদের সৃষ্টি। নানা রকম বাটিক প্রিন্ট দেখতে পারেন। বাজনার সমাবেশও চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। সংগ্রহ করতে পারেন একতারা – বাউলদের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র। হাটে আপনি বাউলদেরও দেখা পাবেন। নাচে-গানে বিভোর। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে আপনারও মন চাইবে। আদিবাসীদের নৃত্যেও অংশ নিতে পারেন।