এই শীতে কলকাতার কাছাকাছি নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ পেতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বসতবাটী দিয়ে ঘুরে আসুন

এটি হাওড়া জেলার অন্তর্গত দেউলটির সমতাবেড় গ্রামে অবস্থিত

শহর কলকাতার কোলাহল এবং ব্যস্ততাপূর্ণ জীবনযাত্রা থেকে ২ দিনের ছুটি নিয়ে যদি নিরিবিলি কোনও জায়গায় কাটানো যায়, তবে ফিরে এসে কাজ করার ক্ষমতা দ্বিগুন বেড়ে যায়। কলকাতা থেকে মাত্র ৬০ কিমি দূরে অবস্থিত এমনই একটি নিরিবিলি জায়গার কথা এখানে বলা হয়েছে। হাওড়া জেলার দেউলটির সমতাবেড় গ্রাম বর্তমানে একটি ছোটোখাটো পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। গ্রামটি কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থানের জন্য এতো বেশি বিখ্যাত। এখানে শরৎচন্দ্র তাঁর জীবনের ১২টি বছর কাটিয়েছেন।

এই বাড়িতে বসেই তিনি লিখেছেন ‘শ্রীকান্ত’, ‘পরিণীতা’, ‘মহেশ’, ‘রামের সুমতি’র মতো একাধিক কালজয়ী গল্প-উপন্যাস। বাড়িতে প্রবেশ করার আগেই ফটকের দু’ধারে লেখা রয়েছে ‘মহেশ’ গল্পের কিছু লাইন। ফটক পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকলেই চোখে পড়বে শরৎচন্দ্রের এক আবক্ষ মর্মর মূর্তি। দ্বিতল এই বাড়িটির চারপাশে রয়েছে বারান্দা। কাঠের সিঁড়ি আর মেঝেতে আছে লাল-সাদা দাবার ছকের নকশা। বাড়ির সামনে আছে ময়ূরের খাঁচা। শোনা যায়, ময়ূর পুষতেন শরৎচন্দ্র, এছাড়া পাখিও পুষতেন। বাড়ির ভেতরে রয়েছে অজস্র গাছ। রয়েছে একটি পুরোনো পেয়ারা গাছ। তাঁর ‘রামের সুমতি’ গল্পে এমনই একটি গাছের কথা পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে একটি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর। কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বাড়িটির সংস্কার করে অভিনব রূপ দিয়েছে। তাঁর বাড়িতে একটি হোমিওপ্যাথি চেম্বার আছে কারণ অনেকে বলেন, শরৎচন্দ্র হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা জানতেন। সেখানে রোগীদের বিনাপয়সায় ওষুধ দিতেন তিনি।

এই গ্রামের আরেকটি বড়ো আকর্ষণ হল রূপনারায়ণ নদ। শরৎচন্দ্রের বাড়ির পাস দিয়েই বয়ে গেছে নদটি। তাঁর বাড়ি থেকে হাঁটা পথে এই নদের দূরত্ব প্রায় ৫ মিনিট। নদের ধারে সুন্দর বসার জায়গাও করা আছে। রূপনারায়ণ খুব শান্ত হলেও মাঝে মাঝে গভীর রূপ নেয়। নদের ধারে বিস্তৃত ধান ক্ষেত। নদের ধারে যাওয়ার আদর্শ সময় হল বিকেলবেলা। এখানে পিকনিক করতে আসেন অনেকেই। স্থানীয় মানুষেরা বলেন যে, শরৎচন্দ্র তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলি লেখার সময়ে পড়ার ঘর থেকে রূপনারায়ণের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। এখন নদেতে সেভাবে নৌকা না চললেও কিছু দূর এগিয়ে গেলে নৌকা বিহার করতে পারবেন। একটু দূরেই রয়েছে বিশাল মাঠ সমেত পানিত্রাস হাইস্কুল। সামনে আছে বিরাট বাঁধানো মঞ্চ। পাশেই আছে শরৎ নাট্যগোষ্ঠী। সাংস্কৃতিক গন্ধে ভরপুর সমতাবেড় গ্রামে একবার হলেও আপনাকে আসতেই হবে।

শরৎচন্দ্রের এই দ্বিতল বাড়িটির সর্বত্রই যেন তাঁর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। বার্মা কাঠের আসবাবপত্রে সাজানো তাঁর বাড়ি। তাঁর লেখার ডেস্ক, জাপানি ঘড়ি, হুঁকো, বইয়ের তাক – সবকিছুই রক্ষিত আছে নিপুণ যত্নে। এছাড়া ধানের গোলা, কাঠের বারান্দা, নীচের উঠোন সব জায়গাগুলোই ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবেন পর্যটকরা। সংরক্ষণ করা হয়েছে লেখকের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলিও। যে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি চিত্তরঞ্জন দাশ উপহার দিয়েছিলেন লেখককে তা রাখা আছে ঠাকুরঘরে। রাধাকৃষ্ণ এখনও প্রত্যেকদিন নিত্য পূজিত হন। যারা ‘রামের সুমতি’ পড়েছে তাদের সবার লেখকের বাড়ির সামনের পুকুরটা দেখেই ‘কার্তিক’, ‘গণেশে’র কথা মনে পড়বেই। এই বাড়িতে অনেক গুণী মানুষের পায়ের ধুলো পড়েছে। এই বাড়িতেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে মিটিং করতেন। দেউলটি বেড়াতে এলে শরৎচন্দ্রের বাড়ি যেকোনও বাঙালি পর্যটকের কাছেই বাড়তি আকর্ষণ। এখন বাড়িটির সংরক্ষণের দায়িত্বে আছেন লেখকের ভ্রাতুষ্পুত্র জয় চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্রের এই বাড়িতে প্রত্যেকটি বাঙালির আবেগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে।

কীভাবে যাবেন-

হাওড়া থেকে ট্রেনে করে পৌঁছে যাবেন দেউলটি স্টেশন। দেউলটি স্টেশন থেকে সমতাবেড়ের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। স্টেশন থেকে ৫-১০ মিনিট হেঁটে তারপর অটো ধরে যাবেন সমতাবেড় গ্রামে শরৎচন্দ্রের কুঠিবাড়ি। পর্যটকের জন্য রাস্তাতেই পথনির্দেশ দেওয়া আছে। অথবা সড়কপথে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন এখানে।

কোথায় থাকবেন-

কলকাতা থেকে সমতাবেড় গ্রামে যাতায়াত একদিনেই হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যদি দু-একদিন এই নিরিবিলি পরিবেশে কাটাতে চান তবে এখানে রিসোর্ট রয়েছে, যেমন- প্রান্তিক রিসর্ট এবং নিরালা রিসর্ট।

Sanjana Chakraborty

Professional Content Writer

Leave a Reply

Your email address will not be published.