উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠের মতো বাংলার শৈল নগর দার্জিলিংয়েও অশনিসংকেত দেখা দিতে পারে, বলছেন ভূবিজ্ঞানীদের একাংশ

বাংলার মানুষও ভূমিধসের কবলে পড়তে পারে

দার্জিলিং: কিছুদিন আগে উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠের অন্তত ৫০০টি বাড়িতে ভয়াবহ ফাটল দেখা দিয়েছিল। একের পর এক রাস্তায় গভীর ফাটল। ধসে গিয়েছে বহু এলাকা। বিপন্ন যোশীমঠ, যা আজ বসবাসের অযোগ্য। ভূমিধস ও ফাটলের জেরে ঘরছাড়া হয়েছেন হাজার-হাজার পরিবার। বলা চলে এখন সংবাদ শিরোনামে শুধুই দেবভূমি। তবে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু প্রশ্ন তো এখানেই উঠছে, কেন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হল যোশীমঠে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোশীমঠ ডুবতে শুরু হওয়ার অন্যতম বড়ো কারণ এই শহরের ভৌগোলিক অবস্থান এবং গঠন। সেই একইরকম দৃশ্য দেখতে চলেছে কী বাংলার শৈল শহর দার্জিলিং?

ভ্রমণপিপাসু বাঙালিদের পছন্দের স্থান হল দার্জিলিং। বিশেষজ্ঞদের মতে দার্জিলিংয়েও একের পর এক নির্মাণ বেড়েই চলেছে। পাহাড়ের কোলে তৈরি হচ্ছে অবৈধ নির্মাণ। পুরসভা সম্প্রতি তার তালিকাও তৈরি করেছে। কিন্তু সব অবৈধ নির্মাণ ভাঙা যায়নি এখনও। এদিকে এই অবৈধ নির্মাণের জেরে চাপ পড়ছে পাহাড়ের বুকে। সম্প্রতি দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ে একের পর এক ধসের ঘটনা ঘটেছে। বিজনবাড়ি, তাকদা সহ বিভিন্ন এলাকায় ধস নামার নজির রয়েছে। কিন্তু তারপরেও অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক নির্মাণ হয়েছে দার্জিলিং, কালিম্পংয়ে। এর সঙ্গে সিকিমও ধসপ্রবন। বর্ষাকাল এলে সেই ধসের প্রবনতাও বাড়তে থাকে। ধসের জেরে অবরুদ্ধ হয়ে যায় রাস্তা, ভেঙে যায় বাড়়ি, প্রাণহানিও হয়। কিন্তু তারপরেও যাবতীয় নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি তৈরি হচ্ছে দার্জিলিংয়ে। একটা সময় পাহাড়ে সাধারণত কাঠের বাড়ি বেশি দেখা যেত। ভূমিকম্পপ্রবন দার্জিলিংয়ে এটাই ছিল রীতি। কিন্তু এখন সেইসব অতীত। কার্শিয়াংয়ের কর্মঠ গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গ্রামেরই খুব কাছ থেকে তৈরি হচ্ছে সেবক-রংপো রেল টানেল। ডিনামাইট ফাটিয়ে সেই টানেল বানাতে গিয়েই নাকি এই বিপত্তি। বিপর্যয় মোকাবিলা বিশেষজ্ঞ ফাটল পরীক্ষা করে বলছেন, এখনই সাবধান না হলে বিপদ আসন্ন।

কার্শিয়াংয়ের কালিঝোড়া থেকে পাহাড়ি রাস্তা ধরে উপরে উঠলেই পড়বে পর্যটনকেন্দ্র লাটপাঞ্চর। সেখানের কর্মঠ ফরেস্ট ভিলেজের একাধিক বাড়িতে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। একদিকে রেলের টানেল আর অন্যদিকে তিস্তার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এই দু’য়ের মাঝে পড়ে যাচ্ছে কালীঝোড়া। শিলিগুড়ি থেকে সিকিমগামী এই পথ বর্ষাকালে বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকে। আর এইসবের মধ্যে বিপদ আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন এখানকার মানুষ। আর সে সব ছবি মনে করাচ্ছে উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠের পরিস্থিতির কথা। শুধু পাহাড়ি এলাকা যোশীমঠ কেন, মেট্রোর টানেল তৈরি করতে গিয়ে কলকাতা শহরের বুকে বৌ-বাজার অঞ্চলেও ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল কয়েকমাস আগেই।

অনেকে বলেন, বাংলার শৈলশহরে ধস নতুন কিছু বিষয় না। তবে দার্জিলিংয়ে নগরায়ন যে ধসের প্রবনতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে একথা খানিকটা হলেও সত্যি। বিশেষজ্ঞরা বারবার বিপদের কথা বললেও তা কানে তোলেনি স্থানীয় প্রশাসন বা সরকার। যার ফলে ধ্বংসের দিন গুনছে উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠ। আর সেই একই অশনিসংকেত দেখা দিতে পারে দার্জিলিংয়ে। ভূবিজ্ঞানীদের কথায়, সরকার যদি এখনই কোনও পদক্ষেপ না নেয় তাহলে এই বিপদ থেকে দার্জিলিংকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, দার্জিলিং পাহাড়ের গঠন প্রক্রিয়া এখনও চলছে। ফলে ওই পাহাড় ভঙ্গুর প্রকৃতির। দার্জিলিং সহ ওই এলাকার পাহাড় ফিলাইট জাতীয় নরম শিলায় গঠিত। একটু বেশি জল পেলেই সেই শিলা গলতে শুরু করে। ফলে সেই শিলা বড় কংক্রিটের নির্মাণের ভার দীর্ঘ সময় ধরে বহন করতে পারে না। ফলে বিপর্যয় ঘটে। অবৈজ্ঞানিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই অবাধে বহুতল নির্মাণ, রাস্তা তৈরি, পাহাড় কাটা সহ নানা কারণে শৈলশহরের বিপদ ঘনাচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে আর্থকোয়েক ডিজাস্টার রিস্ক ইনডেক্স রিপোর্ট তৈরি করেছে। সিসমিক জোন ৩, ৪ এবং ৫-এ থাকা দেশের ভূমিকম্পপ্রবণ ৫০টি গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং একটি জেলা নিয়ে পাইলট প্রোজেক্ট তৈরি হয়েছে। একাধিক বিষয়ের উপর শহরগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে সমীক্ষা চালিয়ে তৈরি হয়েছে একশো পাতার একটি রিপোর্ট। ৫০টি শহরের তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, শিলিগুড়ি ও দার্জিলিং। ভূকম্পনের সম্ভাবনা বিবেচনা করে তৈরি রিপোর্টে শহরগুলিকে অত্যন্ত বিপজ্জনক, বিপজ্জনক এবং কম বিপজ্জনক- এই তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। সিসমিক জোন-৪ এ থাকা দার্জিলিং বিপজ্জনক শহরের তালিকায় রয়েছে। সুতরাং বার বার সাবধান করার পরেও দার্জিলিং নিয়ে কারোর কোনও মাথা ব্যথা নেই। আর এখানেই উঠে আসছে নানান প্রশ্ন।

Sanjana Chakraborty

Professional Content Writer

Leave a Reply

Your email address will not be published.